নিজস্ব প্রতিবেদক: নাম বিচিত্রা রায়। পেশায় একজন স্কুলশিক্ষক। নানামুখী প্রতিভাবান এই নারী শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য জেলা পর্যায়ে জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি নৃত্যকলা, গান, কবিতা আবৃত্তি, অভিনয়, উপস্থাপনাসহ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত।এ ছাড়াও তিনি বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার চালানোর দক্ষতা অর্জন করেছেন। হাতের লেখাও তার খুব সুন্দর। হস্তলেখা অনলাইন পেজও আছে তার। নিয়মিত চর্চাও করেন। তিনি একজন পরিশ্রমী মানুষ। কাজ করা, ব্যস্ত থাকা তাঁর কাছে খুব পছন্দের। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক শিক্ষার বাইরে জীবনের শৃঙ্খলার জন্য সংগীতের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা একজন সুস্থ মানুষের জন্য জরুরি। কেননা পরিবারের বাইরে নৃত্যকলা, কবিতা আবৃত্তি ও গান মানুষকে মানুষের কাছে সহজেই উপস্থাপন করা যায়, নিজেকে পরিপাটি রাখা যায়। এ বিশ্বাস ধারণ করেই তিনি পথ চলেন।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা, শিল্পকর্ম তাঁর অনুপ্রেরণা। তিনি যখন রবীন্দ্র জীবন চরিত নিয়ে আলোচনা শুনেছেন, বই পড়েছেন, তখন জানতে পেরেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৬০ বছর বয়সে ছবি আঁকা শুরু করেছেন। তখন বিচিত্রা রানী বিশ্বাস করেছেন তবে আমি কেন পারব না। আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা চর্চা করি। তাঁর কাব্যিক ভাষা আমাকে আকৃষ্ট করে। শেখার কোনো বয়স নেই এই বিশ্বাস ধারণ করে বিচিত্রা রানী রায় সংগীতের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা শুরু করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় ২০২০ সালে জয়িতা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেছেন এই নারী। বিচিত্রা রানী নীরবে নিভৃতে সংগ্রাম ও কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি কন্যা, জায়া ও জননী তিন রূপে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। কন্যা থাকাকালীন তার অনেক শখ ছিল সংস্কৃতির অঙ্গনে পদচারণা করবেন। কিন্তু মনের গহীনে এই শখ পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেছে।
বাবার সংসারে তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার বড় হওয়ার কারণে শখ পূরণে এগিয়ে আসা যায়নি। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী, সমবায় পরিদর্শক। সংসারে টানাটানির মধ্যে এগুতে পারেননি। তবে পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পাস করে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। ২০০২ সালে রাজবাড়ীর পিত্রালয় থেকে সিরাজগঞ্জে আসেন শশুরালয়ে। শ্বশুর-শাশুড়ি থাকেন গ্রামে। স্বামী ব্যাংকার, তাই শহরে ছোট্ট ভাড়া বাসায় সংসার তাঁর। কিন্তু মনের গহীনে লুকায়িত সুপ্ত বাসনা তার রয়েই গেছে। অদম্য এই নারী পিছিয়ে যেতে রাজি নন। ‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে’ দেশের প্রথিতযশা গীত রচিয়তা আসিফ ইকবালের কথায় নকিব খানের সুরে কনক চাঁপা ও আইয়ুব বাচ্চুসহ অন্যান্য শিল্পীর কোরাস গান তাকে আলোড়িত করেছে। তিনি বিয়ের পরও পড়ালেখায় মনোযোগ দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্সে ভর্তি হলেন। কৃতিত্বের সঙ্গে পাসও করেছেন। এক পর্যায়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরিও পেলেন। এবার তিনি তার মনের গহীনে লুকায়িত সুপ্ত বাসনা পূরণে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। তিলে তিলে নিজেকে নানামুখী প্রতিভায় যুক্ত করতে এগিয়ে এসেছেন।
তিনি প্রতিদিন শহর থেকে গ্রামে গিয়ে শিক্ষকতা শেষ করে আবার শহরে এসে তালিম নিতে থাকেন গানের শিক্ষক, নাচের শিক্ষকের কাছে। অভিনয়, উপস্থাপনা কবিতা আবৃত্তিতেও তালিম নিতে থাকেন। শিক্ষকতা, স্বামী, সংসার সন্তান দেখা শোনাও সমান তালে এগিয়ে যায়। তবে স্বামীর কোন অভিযোগ নেই, তার দুই সন্তানও মাকে সাহায্য করেছে। এ ভাবেই বিয়ের পর দুই দশকে বিচিত্রা রানী নিজেকে সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যিনি রাধেন তিনি চুলও বাঁধেন। এই নারী রন্ধন শিল্পেও পারদর্শী। গ্রামের নারীরা যেমন পুঁতি দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করেন, কুটির শিল্পের কাজ যেমন তালপাতা বাঁশ-বেত দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি, সেলাইয়ের কাজ, পোশাক তৈরি ইত্যাদিতেও তার সফলতার স্বাক্ষর রয়েছে।
নারীর সম-অধিকার বিষয়ে বিচিত্রা রায় জানান, অধিকার নিশ্চিত করতে নিজেকেই লড়াই-সংগ্রামে অংশ নিতে হবে। এ লড়াই কারোর বিরুদ্ধে হিংসাত্মক যুদ্ধ নয়। এ লড়াই সংগ্রাম হবে শান্তিপূর্ণ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই। পড়ালেখার পাশাপাশি নিজে রাজনীতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিচরণ করে নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ঘরে বসে থাকলে কেউ কাউকে তার প্রাপ্য অধিকার দেবে না। তবে খেয়াল রাখতে হবে নিজের প্রতি। বাইরে বের হয়ে নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। পরিবার সমাজের কাছে হেয়প্রতিপন্ন হয় এমন কর্মকান্ড থেকে নিজেকে যত্নবান হতে হবে।