রক্ষকই ছিলেন ভক্ষক
র-নিউজ ডেস্কঃ পুরো ব্যাংক খাতের রক্ষক ছিলেন যিনি, সেই তিনি শুধু বড় বড় লুটেরাদের অপকর্মের দোসরই ছিলেন না, নিজেও ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বাদশ গভর্নর হিসেবে ২০২২ সালের ১১ জুন আব্দুর রউফ তালুকদারকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগদানের এক মাস পর ওই বছরের ১২ জুলাই তিনি গভর্নর হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে ছিলেন অর্থসচিব। প্রসঙ্গত, আব্দুর রউফই একমাত্র গভর্নর, যিনি সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং পলাতক অবস্থায় থেকেই পদত্যাগ করেছেন। ব্যাংক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচারে যোগসাজশের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তারের দাবি জোরালো হচ্ছে।
আব্দুর রউফের সময়কালে সংকটাপন্ন ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ক্ষত আরও বেড়েছে। অভিযোগ আছে, গত দুই বছরে তার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ব্যাংক খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। তিনি ঋণখেলাপি ও লুটেরাদের সুবিধা দিতে তৎপর ছিলেন। আবার বিভিন্ন গ্রুপ থেকে নিজেও অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিকটাত্মীয়দের বিভিন্ন ব্যাংকে চাকরি দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা তার সিদ্ধান্তের বাইরে গেলেই রোষানলের শিকার হতেন। শুধু তাই নয়, এসব কা-কীর্তি আড়াল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ব্যাংক খাতে নানা অপকর্মের এই হোতার এখনো গ্রেপ্তার না হওয়া জনমনে নানা প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, গভর্নর হওয়ার পর আব্দুর রউফ তালুকদার ক্ষমতাসীনদের দলীয় কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ব্যাংক খাতে নেওয়া তার অনেক সিদ্ধান্তই ছিল রাজনীতি-প্রভাবিত। তিনি চিহ্নিত ব্যাংক লুটেরাদের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। এ কারণে সরকার পতনের পর প্রকাশ্যে আসার সাহসটুকু পর্যন্ত পাননি। আত্মগোপনে থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে।
সূত্রগুলো বলেছে, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন থেকেই ঢাকার একটি সংরক্ষিত এলাকায় অবস্থিত ভাইয়ের বাসায় আছেন তিনি। সেখান থেকে সুযোগ পেলেই যুক্তরাষ্ট্রে উড়াল দেবেন। এ বিষয়ে আব্দুর রউফ তালুকদারের কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তার মোবাইল নম্বরে গত কয়েক দিন কল করেও কোনো সংযোগ পাওয়া যায়নি।
ব্যাংক লুটেরাদের দোসর : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার চরিত্র হারিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়ে ওঠে ব্যাংক লুটেরাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের আখড়া। বিতর্কিত এস আলম, বেক্সিমকো, নাসাসহ বিভিন্ন রাক্ষুসে গ্রুপকে লালন-পালন করার ধারাবাহিকতা আব্দুর রউফ তালুকদারও অক্ষুণœ রাখেন। তার সময়ে সবচেয়ে বেশি সুবিধা দেওয়া হয় এস আলম গ্রুপকে। অনিয়ম আর ঋণ জালিয়াতির কারণে দুর্বল হয়ে পড়া ওই গ্রুপের ব্যাংকগুলোকে নগদ সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়। সূত্রগুলো বলেছে, তিনি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং ব্যাংক মালিকদের নিয়ন্ত্রণ না করে উল্টো তাদের অনিয়ম-জালিয়াতিগুলোকে ঢেকে রাখার কাজে বেশি ব্যস্ত থাকতেন। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগগুলোর কর্মকর্তাদের হাত-পা বেঁধে রাখতেন। কোনো প্রভাবশালী লুটেরাগোষ্ঠী অনিয়ম-জালিয়াতি করলেও সেগুলোর কোনো তদন্ত তিনি করতে দিতেন না। আর কর্মকর্তা পরিদর্শনে গিয়ে যেসব অনিয়ম পেতেন, সেগুলোর প্রতিবেদন জমা দিলেও কোনো অ্যাকশন হতো না। এ জন্য তাকে এখন ব্যাংক খাতের লুটেরাদের দোসর হিসেবে অ্যাখ্যা দিচ্ছেন অনেকেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান, রউফ তালুকদারের কারণেই এস আলম, বেক্সিমকো, নাসাসহ লুটেরা গ্রুপগুলো ঢালাও সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। যে কারণে তারা নির্ভয়ে ও নির্বিঘেœ বড় বড় জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব জেনেও নিশ্চুপ ছিল।
কোনো অর্জন নেই, ব্যর্থতার পাল্লা ভারী : দায়িত্ব গ্রহণের পর আব্দুর রউফ তালুকদার ব্যাংক খাত সংস্কার, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভ ও ডলার সংকট উত্তরণসহ বেশকিছু প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু গত দুই বছরে তার কোনো প্রতিশ্রুতি কিংবা উদ্যোগই আলোর মুখ দেখেনি। উল্টো বিভিন্ন সূচকে অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন আবদুর রউফ তালুকদার। ২০২২ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর হিসেবে যখন যোগ দেন, তখন দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। সেই হার বাড়তে বাড়তে ১০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছায়। সর্বশেষ গত জুন শেষে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। আগের অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ০২ শতাংশ।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা ও ডলারের দামে শৃঙ্খলা ফেরাতেও ব্যর্থ হন তিনি। তার সময়কালে ডলারের দাম ব্যাপকহারে বেড়েছে। আবার রিজার্ভেরও অস্বাভাবিক পতন হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ৩০ জুন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের ৩১ জুলাই এ রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এর মধ্যে নিট রিজার্ভ রয়েছে ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। অন্যদিকে আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর পদে দায়িত্ব গ্রহণের সময় তথা ২০২২ সালের জুলাইয়ে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। বর্তমানে প্রতি ডলার ১১৮ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।
ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে পুনঃতফসিলের নীতিমালা ব্যাপক শিথিল করেন আব্দুর রউফ তালুকদার। তার সময়ে মাত্র আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়, আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। আবার এসব ঋণ পরিশোথে ৫ থেকে ৮ বছর সময় দেওয়া হয়, যা আগে ছিল সর্বোচ্চ দুই বছর। শুধু তাই নয়, আগে বিশেষ সুবিধায় খেলাপিঋণ পুনঃতফসিল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। কিন্তু আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে সেই ক্ষমতার পুরোটাই ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেন। এতে ব্যাংক খাতে খেলাপিঋণ না কমে উল্টো আরও বেড়েছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, তিনি যখন গভর্নরের দায়িত্ব নেন, তখন দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে এসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। যদিও প্রকৃত খেলাপিঋণ এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি হবে- বলছেন সংশ্লিষ্টরা।