ইসলামের ইতিহাসে সিরিয়া ও শাম অঞ্চল
সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত একটি আরব দেশ। এটি পশ্চিম এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রতিবেশী দেশগুলো হলো উত্তরে তুরস্ক, পূর্বে ইরাক, দক্ষিণে জর্দান, পশ্চিমে লেবানন ও ভূমধ্যসাগর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে ইসরায়েল (জোলান মালভূমি)। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক (Damascus) যা বিশ্বের প্রাচীনতম অব্যাহতভাবে বসবাসকৃত শহরগুলোর মধ্যে একটি।সিরিয়ার মোট আয়তন এক লাখ ৮৫ হাজার ১৮০ বর্গকিলোমিটার (৭১,৪৯৮ বর্গমাইল)। এটি বিশ্বব্যাপী আয়তনের দিক থেকে মাঝারি আয়তনের একটি দেশ। হাদিসে মুলকে শামের অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আর সিরিয়া শামের একটি অংশ।
সিরিয়া শামের প্রাচীন অংশ হওয়ায় ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয়ভাবে এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। ইসলামে একে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শাম শব্দটি আরবি ভাষায় একটি বিস্তৃত অঞ্চলকে বোঝায়, যা প্রাচীনকালে লেভান্ট (Levant) নামে পরিচিত ছিল। এটি বর্তমানের বেশ কয়েকটি দেশ নিয়ে গঠিত।সিরিয়া, লেবানন, জর্দান, ফিলিস্তিন (যার মধ্যে রয়েছে বর্তমান ইসরায়েল ও পশ্চিম তীর)।মুলকে শাম পবিত্র ও বরকতময় ভূমি, যা ইসলামের ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই অঞ্চলের প্রতি ভালোবাসা এবং এর শান্তিময় হওয়ায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসগুলোতে পাওয়া যায়। তিনি এসব অঞ্চলের জন্য দোয়া করেছেন। পবিত্র মক্কা-মদিনার পর যা অন্য কোনো দেশের ব্যাপারে বলা হয়নি।
অনেক নবী-রাসুল, সাহাবায়ে কিরাম ও বুজুর্গদের ভূখণ্ড হিসেবে প্রসিদ্ধ এই দেশটি। নিম্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদিস উল্লেখ করা হলো—
বরকতময় ভূমি
রাসুল (সা.)-এর পবিত্র মুখে শামবাসীর জন্য বরকতের দোয়া উচ্চারিত হয়েছে। এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের শামের মধ্যে বরকত দিন, আমাদের ইয়েমেনের মধ্যে বরকত দিন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭০৯৪, সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৩৭৪)
অলি-আওলিয়াদের স্থান
শুরাইহ ইবনে উবাইদ (রহ.) বলেন, আলী (রা.) ইরাকে অবস্থানকালে তাকে শামবাসীদের ব্যাপারে বলা হলো, আপনি তাদের ওপর অভিশাপ করুন! তখন তিনি বলেন, না, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে শাম ভূখণ্ডে আবদালরা (আল্লাহর ওলিদের বিশেষ দল) থাকেন, তারা ৪০ জন থাকেন, যখনই তাদের থেকে একজন মারা যান, আল্লাহ তার স্থানে অন্য একজনকে রাখেন, তাদের বরকতে বৃষ্টি হয় এবং শত্রুর ওপর জয়লাভ হয়। ভবিষ্যতে তাদের অসিলায় শামবাসীদের থেকে আজাব উঠিয়ে নেওয়া হবে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮৯৬)
শামে অবস্থান করার ফজিলত
নবীজি (সা.) শামকে বসবাসের জন্য নির্বাচন বলেছেন। ইবনে হাওয়ালা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, অদূর ভবিষ্যতে ইসলামী হুকুমাত এমন বিস্তার লাভ করবে যে তোমরা সবাই সংগঠিত সেনাবহিনীতে যোগদান করবে। একটি সেনাবাহিনী সিরিয়ায়, অপরটি ইয়েমেনে এবং আরো একটি ইরাকে গঠিত হবে। এরূপ ভবিষ্যদ্বাণী শুনে ইবনে হাওয়ালা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি ওই সময়টি পাই, তবে আমার জন্য কোথায় থাকা উত্তম হবে? তিনি বলেন, তোমার জন্য সিরিয়ায় থাকা উত্তম হবে। কারণ তা হবে আল্লাহর জমিনসমূহের মধ্যে বাছাইকৃত সর্বোত্তম জমিন। আল্লাহর নেক বান্দারা ওই জমিন চয়ন করে নেবেন। তোমরা যখন তাতে বসতি স্থাপন করবে তখন তোমাদের ডান দিক বেছে নেবে এবং প্রথমেই পানির কূপ খননের ব্যবস্থা করবে। কারণ আল্লাহ আমার অসিলায় সিরিয়া ও তার অধিবাসীদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৮৩)
শেষ যুগে শামের ভূমিকা
শেষ যুগে শামকে ইসলামের পুনর্জাগরণ ও সংঘর্ষের কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই ওই ফিতনার সময় নবীজি (সা.) শামে অবস্থান করার কথা বলেছেন। সালিম ইবনে আবদুল্লাহ তার পিতা আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের আগে হাজরামাওত (কিংবা হাজরামাওতের সমুদ্রের দিক থেকে) থেকে অবশ্যই একটি আগুন বের হবে এবং লোকদের একত্র করবে। সাহাবিরা বলেন, তখন আমাদের কি করার নির্দেশ দেন, হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বলেন, তখন তোমরা শাম অঞ্চলকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২২১৭)
দাজ্জালের বিরুদ্ধে শামে ইমাম মাহদী ও ঈসা (আ.)-এর ভূমিকা
নাউওয়াস ইবনে সামআন (রা.) সূত্রে বর্ণিত, একটি হাদিসে দাজ্জাল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দাজ্জাল ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে বের হবে এবং ডানে-বাঁয়ে গোটা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করতে থাকবে। তাই হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা ঈমানের ওপর অটল থাকবে।’
দীর্ঘ হাদিস বর্ণনার এক পর্যায়ে নবী করিম (সা.) বলেন, দীর্ঘ ৪০ দিন ধরে দাজ্জালের অনিষ্টতার পর আল্লাহ ঈসা ইবনে মারিয়াম (আ.)-কে পাঠাবেন। তিনি দামেস্কের পূর্ববর্তী এলাকার শুভ্র মিনারের কাছে আসমান থেকে দুজন ফেরেশতার কাঁধে চড়ে অবতরণ করবেন। তখন তার শ্বাস-প্রশ্বাস যে কাফিরের গায়ে লাগবে, সে মারা যাবে আর তার দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে তার শ্বাস-প্রশ্বাস পড়বে। তিনি দাজ্জালকে তালাশ করবেন, অতঃপর শামের বাবে লুদ নামক স্থানে তাকে হত্যা করবেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৯৩৭)
শামের অমঙ্গল সবার জন্য অমঙ্গল
শামে যদি দুর্যোগ হয় তাহলে এটি পুরো বিশ্ববাসীর জন্য অশনিসংকেত এবং শামে সর্বদা আল্লাহ তাআলার একটি দল সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। মুআবিয়া ইবনে কুররা তার পিতা কুররা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শামবাসীরা যখন খারাপ হয়ে যাবে তখন আর তোমাদের কোনো মঙ্গল নেই। আমার উম্মতের মধ্যে একদল সব সময় বিজয়ী থাকবে, তাদের যারা লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করবে তারা কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২১৯২)
আমাদের উচিত শামের বরকত ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করা। শামের জন্য দোয়া করা, কারণ এটি একটি পবিত্র স্থান। শামের মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা এবং তাদের সাহায্য করা।