জীবন যাপনশিরোনাম

তালাক দিচ্ছেন নারীরা বেশি

র-জীবন যাপন ডেস্কঃ  দেশে দিনদিন তালাক হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। রাজধানীতে এ সংখ্যা বেশি। গেল বছর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে তালাকের আবেদন আসে ১৩ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পাঁচ হাজার ৫৯০টি, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সাত হাজার ৬৯৮টি।ঠুনকোসহ ছোট-বড় নানা কারণে রাজধানীতে তালাকের সংখ্যা বাড়ছে। সংসার থেকে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে তালাক হওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- পরকীয়া, মাদকাসক্ত, চাকরি বা অন্য কিছুর সঙ্গে জড়িত হওয়া, সময় না দেওয়া, নির্যাতন, যৌতুক, মানসিক পীড়ন, বেপরোয়া জীবন, বদমেজাজ, সংসারে উদাসীনতা, অবাধ্য হওয়া, পুরুষত্বহীনতা, শারীরিক চাহিদায় অপূর্ণতা এবং সন্তান না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে।
২০২২ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোট তালাকের সংখ্যা সাত হাজার ৬৯৮টি। এর মধ্যে স্ত্রীর মাধ্যমে তালাক হয়েছে পাঁচ হাজার ৩৮৩টি। স্বামীর মাধ্যমে তালাকের সংখ্যা দুই হাজার ৩১৫টি।২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা ‍দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোট তালাক হয়েছে ৬৫০টি। এর মধ্যে স্ত্রীর মাধ্যমে তালাকের ঘটনা ৪৫০টি আর স্বামীর মাধ্যমে ২০০টি

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত জুন মাসে প্রকাশ করা জরিপের ফল অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে তালাকের সংখ্যা বেড়েছে। গত এক বছরে তালাকের হার বেড়েছে ১.৪ শতাংশ। যা আগে ছিল ০.৭ শতাংশ। এ সময় ঢাকায় গড়ে ৪০ মিনিটের ব্যবধানে একটি করে তালাকের ঘটনা ঘটেছে। পরিসংখ্যান বলছে গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোট তালাকের সংখ্যা সাত হাজার ৬৯৮টি। এর মধ্যে স্ত্রীর মাধ্যমে তালাক হয়েছে পাঁচ হাজার ৩৮৩টি। স্বামীর মাধ্যমে তালাকের সংখ্যা দুই হাজার ৩১৫টি। অর্থাৎ পুরুষের চেয়ে নারীরা তালাক বেশি দিয়েছেন।২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা ‍দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোট তালাক হয়েছে ৬৫০টি। এর মধ্যে স্ত্রীর মাধ্যমে তালাকের ঘটনা ৪৫০টি আর স্বামীর মাধ্যমে ২০০টি। অন্যদিকে, পূর্ণ তালিকা প্রস্তুত শেষ না হলেও খসড়া হিসাবে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রতি মাসে ৪০০ থেকে ৭০০টি করে তালাকের ঘটনা ঘটেছে। এখানেও তালাক প্রদানে এগিয়ে নারীরা।অন্যদিকে, গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোট তালাকের ঘটনা ঘটে পাঁচ হাজার ৫৯০টি। এর মধ্যে স্ত্রীর মাধ্যমে তালাক দেওয়ার ঘটনা তিন হাজার ৬১৯টি, স্বামী দিয়েছেন এক হাজার ৯৭১টি। চলতি বছরের (২০২৩ সাল) জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এখানে মোট তালাকের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৯৯৯টি। ঢাকা দক্ষিণের মতো উত্তর সিটি কর্পোরেশনেও পুরুষের তুলনায় নারীদের পক্ষ থেকে তালাক দেওয়ার সংখ্যাটা বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত জুন মাসে প্রকাশ করা জরিপের ফল অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে তালাকের সংখ্যা বেড়েছে। গত এক বছরে তালাকের হার বেড়েছে ১.৪ শতাংশ। যা আগে ছিল ০.৭ শতাংশ। এ সময় ঢাকায় গড়ে ৪০ মিনিটের ব্যবধানে একটি করে তালাকের ঘটনা ঘটেছে।আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন ও বাঙালি সংস্কৃতির পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধনের প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্ব যে ক্ষণস্থায়ী, এ মাধ্যম সংসারে অশান্তি ডেকে আনতে পারে— এ বিষয়ে সবাইকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ এখনও ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসরণ করে হয়। আইন অনুযায়ী, এলাকা বিবেচনায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের কার্যালয়ে তালাকের আবেদন পাঠাতে হয়। বসবাসের ঠিকানা থেকে আবেদনটি সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে আসে। এরপর মেয়রের কার্যালয় আবেদন নথিভুক্ত করে। বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়লে কর্তৃপক্ষ আবেদনকারী ও বিবাদী উভয় পক্ষকে আপস নোটিশ পাঠায়। সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা এ দায়িত্ব পালন করেন। দুই পক্ষের সমঝোতা না হলে কর্তৃপক্ষ আর কোনো দায়িত্ব নেয় না। আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে কোনো পক্ষ আপস না করলে কিংবা আবেদন তুলে না নিলে আইনগতভাবে তালাক কার্যকর হয়ে যায়।এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, আগে তালাক হতো স্ত্রীকে নির্যাতন, যৌতুকের চাহিদা— এসব কারণে। এখন বেশির ভাগ আবেদনে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন, ভুল বোঝাবুঝি, পরকীয়া, পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে একসঙ্গে না থাকার আগ্রহ, সংসারের আর্থিক চাহিদা পূরণ করতে না পারা, নারীদের চাকরিসহ নানা বিষয় উল্লেখ থাকছে। সবমিলিয়ে মানুষের মধ্যে সহনশীলতা এবং মেনে না নেওয়ার প্রবণতা দিনদিন কমে আসছে। তবে, বর্তমানে নারীদের পক্ষ থেকে তালাকের আবেদনটা বেশি পড়ছে।বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমান সময়ে পারিবারিক কলহ, বিচ্ছেদ— ইতিহাসের সব রেকর্ড যেন ভেঙে ফেলছে। সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্য, মানুষের রুচির পরিবর্তন, পারিবারিক বন্ধন না থাকা, যৌথ পরিবার বিলুপ্তির পাশাপাশি নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে বেশি। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো- আমাদের সামাজিক অবক্ষয় এবং যৌথ পরিবারের বিলুপ্তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কারণে সহসাই নারী বা পুরুষ অন্য কোনো পুরুষ বা নারীর সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত বা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে একে-অপরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে ফেলছেন।‘মাথার ওপর মুরব্বি বা অভিভাবক না থাকা, অন্যদিকে যৌথ পরিবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিলুপ্তি হওয়ায় সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে কেউ এগিয়ে আসছেন না। নিজেদের মধ্যে জবাবদিহিতার জায়গাটাও হারিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পারিবারিক অশান্তি, পাশাপাশি প্রকৃতির পরিবর্তনের ফলে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিকৃত মানসিকতা— অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনা (তালাক) রোধ করতে না পারার অন্যতম কারণ।’সীমাহীন প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়া এবং একে-অপরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়ায় বর্তমানে এমন ঘটনা বাড়ছে। স্বামী ও স্ত্রী দুজনই ভাবছেন আমিই সঠিক, আমিই উপযুক্ত। পরস্পরের প্রতি নির্ভরতা ও দৃঢ় বন্ধুত্বের বন্ধন ছিন্ন হওয়া এবং নিজে নিজেকে চালিয়ে নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে তালাকের ঘটনা।
কীভাবে মুক্তি মিলবে— জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদা এরশাদ নাসির বলেন, ‘আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন ও বাঙালি সংস্কৃতির পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধনের প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্ব যে ক্ষণস্থায়ী, এ মাধ্যম সংসারে অশান্তি ডেকে আনতে পারে— এ বিষয়ে সবাইকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।’সার্বিক বিষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদা এরশাদ নাসির বলেন, ‘পুরো সমাজেই অস্থিরতা, সবার মধ্যে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। এর প্রভাব পারিবারিক জীবনে, বৈবাহিক জীবনেও পড়ছে। আগে মানুষের মধ্যে তেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। এগুলো থেকে দিনদিন আমরা যেন বিচ্যুত হয়ে পড়ছি। আগে সম্পর্কের মধ্যে যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল, এখন সেটি আর লক্ষ্য করা যায় না। কমে আসছে। একজন অন্যজনকে কষ্ট দিতে পারলে, সম্মান দিতে না পারলে মনে হয় বেশি খুশি হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শ্রদ্ধাবোধটা হারাতে হারাতে আজ এ পর্যায়ে এসেছে। নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা যদি না থাকে তাহলে সে সম্পর্কটা চলার কথা নয়, বাস্তবে এটাই হচ্ছে। তালাকের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে।’‘সীমাহীন প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়া এবং একে-অপরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়ায় বর্তমানে এমন ঘটনা বাড়ছে। স্বামী ও স্ত্রী দুজনই ভাবছেন আমিই সঠিক, আমিই উপযুক্ত। পরস্পরের প্রতি নির্ভরতা ও দৃঢ় বন্ধুত্বের বন্ধন ছিন্ন হওয়া এবং নিজে নিজেকে চালিয়ে নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে তালাকের ঘটনা।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button