সুষ্ঠু নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ আছে কিনা এবং সব দল ভোটে অংশ নেবে কিনা– এ দুই প্রশ্নের জবাব খুঁজছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ সফরে আসা দলটি গতকাল শনিবার আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং এবি পার্টির সঙ্গে পৃথক বৈঠকে এ দুটি বিষয়ে জানতে চেয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।দুই প্রশ্নে জোর দিলেও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আরও কিছু বিষয়ে জানতে চেয়েছে সেলোরি রিকার্ডোর নেতৃত্বাধীন ইইউ প্রতিনিধি দল। এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের উত্তর এবং বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য ও পরামর্শ শুনেছে। তবে নিজেদের মতামত জানায়নি। সংলাপ, নির্বাচনকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও কোনো কথা বলেনি দলটি। ঢাকায় ইইউ দূতাবাস সূত্র জানায়, বিএনপি, জাপা ও জামায়াত নেতাদের কাছে সব দলের জন্য সমতা বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রসঙ্গে জানতে চায় ইইউ দলটি। সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে কী কী বাধা রয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন করেছে তারা। বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের ভূমিকা এবং নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতার বিষয়েও তিন দলের মতামত জানতে চাওয়া হয়।তাদের জিজ্ঞেস করা হয়, নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা। আওয়ামী লীগের কাছে অবশ্য এসব প্রশ্ন করা হয়নি। বিএনপি ও জামায়াত বলেছে, বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। আর জাপা বলেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় রয়েছে।ক্ষমতাসীন ও বাকি চার দলের কাছেই বিদ্যমান আইন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অনুকূলে কিনা, তা জানতে চাওয়া হয়। তারা জানতে চায়, আগামী নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠালে তারা কীভাবে দেখবে। আওয়ামী লীগ ও জাপা বলেছে, পর্যবেক্ষক পাঠালে স্বাগত জানানো হবে। তবে বিএনপি ও জামায়াত জানায়, নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার নিশ্চয়তা থাকলে পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানানো হবে। পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে কি হবে না– এ বিষয়ে দলগুলোকে কিছু বলেননি ইইউ প্রতিনিধিরা। তবে জানা গেছে, পর্যবেক্ষক পাঠানোর ক্ষেত্রে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকেই গুরুত্ব দিচ্ছে প্রতিনিধি দলটি।বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, নির্বাচন কীভাবে হবে, সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে কী কী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে– তা জানতে চেয়েছেন ইইউ প্রতিনিধিরা। তারা বিএনপির বক্তব্য শুনেছেন। নিজেদের মতামত জানাননি।
আওয়ামী লীগকে যেসব প্রশ্ন
ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বৈঠককালে ইইউ প্রতিনিধিরা সংবিধান, আইনি ব্যবস্থা ও বিধিবিধান সমুন্নত রেখে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিজেদের প্রত্যাশার কথা জানান। এ তথ্য জানিয়ে বৈঠকে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ সমকালকে বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকার কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা তোলেনি ইইউ।
ইইউর প্রতিনিধিরা আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে নির্বাচনের ফ্রেমওয়ার্ক (কাঠামো), প্রস্তুতি এবং প্রার্থী মনোনয়ন সম্পর্কে জানতে চান। একই সঙ্গে নির্বাচন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে সরকারের পদক্ষেপগুলোও জানতে চান। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের নির্বাচনী প্রস্তুতিসহ মনোনয়ন প্রক্রিয়া তুলে ধরা হয়।
নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা প্রশ্নে আওয়ামী লীগ বলেছে, ২০০৯ সালের আগে নির্বাচন কমিশন কাগজে-কলমে স্বাধীন ছিল। এখন নির্বাচন কমিশনকে আর্থিক, জনবল, প্রযুক্তি ও কারিগরি সক্ষমতা– সব দিক থেকেই স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। মুক্ত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে ।
নির্বাচনী আইনের বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা ইইউ প্রতিনিধিদের জানান, এ-সংক্রান্ত ৬৬টি আইন হয়েছে। এর ৫৫টিই আওয়ামী লীগ করেছে। এগুলো নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব এনেছে। পৃথিবীর কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীই তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা ছাড়তে চান না। আগে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দিতেন। নতুন আইনে প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার খর্ব করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সসহ নির্বাচন ব্যবস্থা সুষ্ঠু করার অন্য পদক্ষেপগুলোও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দল ইইউ প্রতিনিধিদের আরও বলে, নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও সামরিক শাসকদের করা পাঁচটি আইনের সবকটি ছিল ভোট কারচুপিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে। আওয়ামী লীগ সরকার সেখান থেকে সরিয়ে এনে নির্বাচন ব্যবস্থার অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করেছে। এই সরকারের নেতৃত্বে গত দুটি জাতীয় নির্বাচনসহ সব উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও এর প্রমাণ মিলেছে। ভোটের অধিকার নিশ্চিত ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণে গণমাধ্যমকে সুরক্ষা দিতে আইনের সংস্কার করা হয়েছে।
বর্তমান সরকারের পদক্ষেপে ইইউর প্রতিনিধিরা সন্তোষ প্রকাশ করেন বলে আওয়ামী লীগ সূত্র দাবি করেছে। তারা বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থাই নিখুঁত নয়। এমনকি পাশ্চাত্যের নির্বাচন ব্যবস্থাও ত্রুটিমুক্ত নয়। সংশ্লিষ্ট দেশের পরিবেশ, পরিস্থিতি ও আইনি বিধিবিধান অনুযায়ী নির্বাচন ব্যবস্থাকে উন্নত করা সম্ভব। ইইউ বিভিন্ন দেশের নির্বাচন ও নির্বাচন ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে কোনো ত্রুটি পেলে তা থেকে উত্তরণে বিজ্ঞানসম্মত সুপারিশমালা দিয়ে থাকে। তার কতটা গ্রহণ করা হবে– সংশ্লিষ্ট দেশ ও সরকারের ওপর তা নির্ভর করে। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপও করতে চায় না ইইউ।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান সমকালকে বলেন, ইইউর প্রতিনিধিরা ১৫ দিনের সফর শেষে সার্বিক বিষয়ে প্রতিবেদন দেবেন বলে জানিয়েছেন। এর পর আগামী জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিএনপির কাছে জিজ্ঞাসা
বিএনপির কাছে পুরো নির্বাচন পদ্ধতি, প্রক্রিয়া এবং প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জানতে চান ইইউর প্রতিনিধিরা। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কী কী পদক্ষেপ দরকার বলে বিএনপি মনে করছে– তাও জানতে চান। এ বিষয়ে বিএনপি নেতারা নির্বাচন প্রক্রিয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এবং বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বিগত নির্বাচনগুলোর পরিসংখ্যান তুলে ধরেন।
নির্বাচনী আইনের বিষয়ে বিএনপি নেতারা জানান, আওয়ামী লীগ আদালতকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেছে। আদালতের সংক্ষিপ্ত রায়কে পরিবর্তন করে ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে। সব দল ও মতের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে একতরফাভাবে দলীয় সরকারের অধীনে কীভাবে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে, ২০১৮ সালে কীভাবে দিনের ভোট রাতে করা হয়েছে– তার বিবরণ তুলে ধরেন বিএনপি নেতারা।
সুষ্ঠু নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ আছে কিনা প্রশ্নে বিএনপি নেতারা বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন যে হবে না, তার লক্ষণ প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে। ভোট চুরির প্রক্রিয়া এখনই চলছে। কারাদণ্ড, মিথ্যা মামলার পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে বিএনপি কী বলেছে– জানতে চাইলে আমীর খসরু সমকালকে বলেছেন, সব সময় বলে আসছি, বাংলাদেশের জনগণ যা বলছে, বিশ্ববিবেকও তাই বলছে। এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, সম্ভব না। মূল কারণগুলো হচ্ছে, এদের অধীনে নির্বাচন হবে না।
প্রশাসন ও বিচার বিভাগের ভূমিকা প্রসঙ্গে বিএনপি নেতারা ইইউ প্রতিনিধিদের জানান, ভোট প্রভাবিত করতে দলীয় অনুগত ডিসি-এসপি বদলি হচ্ছে, বিএনপি নেতাদের গ্রেপ্তার অব্যাহত আছে। যুবদল নেতার হাত কেটে ফেলা, বিএনপির জনসভায় বাধা দেওয়ার কথাও উল্লেখ করেন তারা। সরকার বিএনপি নেতাকর্মীদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে সাজার ব্যবস্থা করছে, যাতে তারা নির্বাচন করতে না পারে। এসব কাজ তারা প্রতিদিন করছে ভোট চুরির জন্য। কারণ, তারা নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করে জোর করে আবার ক্ষমতায় আসতে চায়। স্বাভাবিকভাবে এ কথাগুলো আজকের আলোচনা এসেছে। তারা বলেছেন, এ সরকারের অধীনে দেশের মানুষ তাদের ভোট প্রয়োগ করে নিজেদের পছন্দমতো জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে না।
জাপা ও জামায়াতের মতামত
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ইইউ প্রতিনিধি দল নির্বাচন-সংক্রান্ত প্রায় সব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে; জামায়াতের বক্তব্য শুনেছে। পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে নিজেদের মতামত জানায়নি। তবে তাদের মনোভাবে মনে হয়েছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। জামায়াত নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা জানতে চেয়েছে। জামায়াত জানিয়ে দিয়েছে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই অংশ নেওয়া অসম্ভব।
বৈঠকে অংশ নেওয়া জাপা চেয়ারম্যানের বিশেষ দূত মাশরুর মওলা বলেছেন, অন্য প্রশ্নের সঙ্গে ইইউ প্রতিনিধিরা জানতে চেয়েছিলেন, জাপা এককভাবে নাকি কারও সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে অংশ নেবে। জবাবে জাপা জানিয়েছে, এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি চলছে।