Uncategorized

পদ হারালেন ওয়াসা চেয়ারম্যান

"এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগের খেসারত "

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে মুখ খোলার পরই চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হলো প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফাকে। ওয়াসা বোর্ডের আরেক সদস্য সুজিত কুমার বালাকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। গত ২১ মে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো: আকবর হোসেন স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়।

২০২০ সালের গত ৯ সেপ্টেম্বর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ওয়াসা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুর রশিদ সরকার মারা গেলে ওই বছরের ১২ অক্টোবর প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফাকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। এর আগেও ২০০৯-১২ মেয়াদে ঢাকা ওয়াসার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন গোলাম মোস্তফা। সর্বশেষ মেয়াদে তাকে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন কোনো চেয়ারম্যান নিয়োগ না দেয়ায় নিয়ামানুযায়ী তিনি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন।

জানা যায়, প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফার ওয়াসা চেয়ারম্যান হিসেবে মেয়াদ বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। বরং এমডিকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা চলছিল। কিন্তু গত ১৭ মে চেয়ারম্যান মন্ত্রণালয়ে এমডির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেয়ার পর পরিস্থিতি আচমকাই উল্টে গেছে। এখন চেয়ারম্যানই তার পদ হারিয়েছেন। আর বহাল তবিয়তে রয়ে গেলেন এমডি তাকসিম এ খান।

ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে অংশ নেন। সেখানে তিনি সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ তোলেন। বোর্ড চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি ভিত্তিতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে গত ১১ মে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিনটি সংগঠনের নামে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেয়া হয়।

ঢাকা ওয়াসা শ্রমিক ইউনিয়ন (সিবিএ), ঢাকা ওয়াসা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ঢাকা ওয়াসা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরে এ চিঠি দেয়া হয়। মন্ত্রণালয়ে দেয়া চিঠিতে তারা অভিযোগ করেন, ‘টক শোতে বোর্ড চেয়ারম্যান বলেছেন, ওয়াসা আইনে প্রবিধান তৈরির বিষয়ে বলা হলেও তা তৈরি করা হয় না। ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয় না, যাতে নিজ ইচ্ছামতো কাজ করা যায়। যেহেতু এটা দেখার কেউ নেই। কাজেই যা খুশি তাই করবে।’ চিঠিতে আরো বলা হয়, বোর্ড চেয়ারম্যান টক শোতে বলেছেন, ‘ওয়াসা বোর্ডকে বাইপাস করে সবকিছু করার চেষ্টা করা হয়। ১৯৯৬ সালের ওয়াসা আইন অনুযায়ী ঢাকা ওয়াসা চলছে না।’

এরপর গত ১৭ মে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে এমডি তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন। এতে তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান স্বৈরাচারী কায়দায় ওয়াসাকে ব্যক্তিগত সম্পদের মতো ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া ওয়াসাকে তিনি নানা অনিয়ম, অপচয় ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন।

তিনি আরো বলেন, তাকসিম এ খান ওয়াসা বোর্ডের সাথে অসহযোগিতা করেন। ওয়াসা বোর্ডকে অবমাননা দীর্ঘ দিন থেকে চলে আসলেও বর্তমানে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আমি ঢাকা ওয়াসার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একাত্তর টিভিতে খোলামেলা বক্তব্য রাখি। সেখানে আমি যা বলেছি সব সত্য বলেছি এবং ঢাকা ওয়াসাকে বাঁচাতে এসব কথা বলার প্রয়োজন আছে। এরপর এমডি সাহেব বিদেশে অবস্থান করে ওয়াসার বিভিন্ন কর্মকর্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমার বিরুদ্ধে মানববন্ধন, জোর করে চেয়ারম্যানের পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর নেয়া ইত্যাদি করতে ব্যর্থ হয়ে সবশেষে মেয়াদ উত্তীর্ণ অবৈধ (এমডি কর্তৃক মনোনীত) বিভিন্ন সমিতিকে দিয়ে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দায়ের করান।

অভিযোগপত্রে চেয়ারম্যান উল্লেখ করেন, ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের নিজস্ব কোনো সচিবালয় নেই। কোনো কর্মকর্তাও নেই। বোর্ড সচিব নামে কোনো পদও অর্গানোগ্রামে নেই। ঢাকা ওয়াসার সচিব পদে পূর্বে সরকার থেকে প্রেষণে একজন কর্মকর্তা আসতেন। এমডি তাকসিম এ খান কায়দা করে তাকে গ্রহণ না করে বেআইনিভাবে নিজের আজ্ঞাবহ একজন প্রকৌশলীকে (যার প্রবিধান মতে এ পদের কোনোই যোগ্যতা নেই) এ পদে অতিরিক্ত দায়িত্বে রেখে দিয়েছেন। তাকেই আবার বেআইনিভাবে বোর্ড সচিব বলে থাকেন। এই সচিবকে এমডি অনেক দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। বলা হয় তিনি প্রশাসনের প্রধান। অথচ ঢাকা ওয়াসায় একজন অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন ডিএমডি (মানবসম্পদ ও প্রশাসন) আছেন। তিনি স্ব-উদ্যোগে অনেক কাজ শুরু করায় এবং বেশ কিছু অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয়ায় এমডি তাকে সাইডলাইনে রেখে দিয়েছেন, এমনকি ভুয়া অভিযোগ তুলে তাকে বরখাস্ত করার চেষ্টাও করেছেন। কারণ, এমডি বুঝতে পেরেছেন যে তিনি তার আজ্ঞাবহ হবেন না। ঢাকা ওয়াসার বর্তমান সচিব বোর্ড-চেয়ারম্যান বা বোর্ড সদস্য কারো কাজ করেন না। তাকে ডেকেও পাওয়া যায় না। এমডি অফিসে না থাকলে তিনিও থাকেন না। তাছাড়া তিনি এমডির পারসোনাল কর্মকর্তার মতো কাজ করেন। বোর্ডের কাজ তাকে দিয়ে করানো যায় না। আগে যখন সরকার থেকে প্রেষণে ওয়াসার সচিব আসত তখন বোর্ড কাজ করতে পারত। এই পদ্ধতিটি আবারো চালু করা জরুরি মনে করছি।

ওয়াসা চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, আমি বারবার বোর্ড সভায় বোর্ডের দুইজন নিজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি এমডি তাকসিম এ খান এর টালবাহানার কারণে। এভাবেই এমডি নিজের অবৈধ ক্ষমতার দাপট দেখাতে বোর্ডকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিজের সুবিধামতো প্রশাসন তৈরি করে রেখেছেন। তিনি বলেন যে তিনি বোর্ডেরও প্রধান নির্বাহী। তার কোনো জবাবদিহিতা নেই। তার অনিয়ম-অপশাসনের ফিরিস্তি বড় লম্বা যা এখানে লেখা সম্ভব না। আইনে পরিষ্কার উল্লেখ থাকলেও তার বিদেশে ছুটিতে অবস্থানকালীন সময়ে বোর্ড সভা করতে তিনি বাধা দিয়েছেন। তার চাহিত এজেন্ডা ছাড়া বোর্ড সভা হবে না এমন দাবির মুখে বোর্ড সদস্যদের সাথে অনেক বাগিাবতণ্ডা হয়েছে। তারপরও এখনো তিনি সেই পথেই হাঁটেন। ঢাকা ওয়াসার বাজেটে তিনি কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন আইটেমে লুকিয়ে রাখেন এবং ইচ্ছামতো বাজেট বহির্ভূত খরচ করেন। বোর্ড কোনো আইটেমের বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তারপরও আগামী বছরের বাজেটে বোর্ড সদস্যরা এবার অনেক খরচ কমিয়ে অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকা লাভ দেখিয়েছেন। তার একমাত্র উদ্দেশ্য বোর্ডকে বাইপাস করে ঢাকা ওয়াসাকে নিজের ইচ্ছামতো পরিচালনা করা।

গোলাম মোস্তফা অভিযোগ করেন, ঢাকা ওয়াসার ভেতরের অবস্থা খুবই খারাপ। যেই তার বিরুদ্ধে কথা বলে তাকেই তিনি চাকরি থেকে অপসারণ করেন। অতীতে এ ধরনের ঘটনা শত শত। চাকরি হারানোর ভয়ে তাই কেউ মুখ খোলে না। একটি সরকারি সংস্থা এভাবে চলতে পারে না। গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাওয়া ঠেকাতে ১৫ বছর আগে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশী ঋণ নিয়ে পানি শোধনাগার নির্মাণ শুরু করলেও এখন পর্যন্ত শতকরা ৭৫ ভাগই ভূগর্ভস্থ পানির উপর ওয়াসা নির্ভরশীল। এ সময়ে গভীর নলকূপের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। প্রকল্প শুরু হয় তো আর শেষ হয় না। খরচ বেড়ে হয় আকাশচুম্বী। এসব নিয়ে এমডির মাথা ব্যথা নেই। ৩৮০০ কোটি টাকায় নির্মিত পদ্মা পানি শোধনাগার তিন বছর ধরে অর্ধেক ক্যাপাসিটিতে চলছে। বোর্ড থেকে নিজস্ব অর্থায়নে প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকা খরচ করে তিন বছরে ঢাকার একদিকে প্রয়োজনীয় ডিস্ট্রিবিউশন পাইপলাইন নির্মাণ করতে বললেও এমডি তাতে কান দেন না। অথচ পানির অভাবে এ বছর লাখ লাখ মানুষ কষ্ট পেয়েছে ও পাচ্ছে।

ওয়াসা চেয়ারম্যান বলেন, ঢাকা ওয়াসায় দুর্নীতির চিত্র ভয়াবহ। বর্তমানে জনবল আউটসোর্সিং এ চলছে লঙ্কাকাণ্ড। এমডির আশপাশের লোকেরা নিজেরা লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে জনবল সংগ্রহ করে কনট্রাক্টরের নামে পোস্টিং নেয়। যে সংখ্যক আউটসোর্সড স্টাফকে বেতন দেয়া দেখানো হয়, বাস্তবে আছে তার চেয়ে অনেক কম। বারবার বলা সত্ত্বেও জনবল আউটসোর্সের বিষয়টি বোর্ডসভায় উপস্থাপন করা হয় না। এত সমস্যার মাঝে ঢাকা ওয়াসা চললেও বোর্ডের যেন কিছুই করণীয় নেই। বোর্ডকে বাইপাস করে বোর্ডের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে চলছে ঢাকা ওয়াসা। গোলাম মোস্তফা বলেন, এমডি তাকসিম খান শুধু পানির মূল্য বৃদ্ধি করতে আগ্রহী, যদিও এর কোনো প্রয়োজন নেই। অনিয়ম, অপচয় আর লুটপাট কমিয়ে আনলে মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া ওয়াসা বোর্ডের একজন সদস্য হিসেব করে প্রমাণ করেছেন, পানির উৎপাদনের যে খরচ দেখানো হয় তা ভুল। এসব নিয়ে বোর্ডে আলোচনা করতেও আগ্রহী নন এমডি।

এ বিষয়ে বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, সাধারণত তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হলেও আগের চেয়ারম্যান মারা যাওয়ায় আমাকে তার বাকি মেয়াদ দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। আরো ছয় মাস আগে মেয়াদ শেষ হয়েছে। আর কাউকে দায়িত্ব না দেয়ায় আমি নিয়মানুযায়ী দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু এখন আমাকে হঠাৎ করে সরিয়ে দেয়ার কারণ মূলত এমডির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছি এজন্য। এ ছাড়া আর কোনো কারণ নেই।

র- নিউজ/বিশেষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button